লোভনীয় বিজ্ঞাপনে মৃত্যুর ফাঁদে ইউরোপ যাত্রায় বাংলাদেশী
ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে পূর্ব ইউরোপ এবং বলকান রাষ্ট্র সমূহে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অনেক লোভনীয় পোস্ট। এমনি একটি বিজ্ঞাপনে কিছুদিন পূর্বে বলা হয়েছিল জরুরী ভিত্তিতে সার্বিয়ায় লোক নিয়োগ করা হবে। এখন আবার আরেকটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায় জরুরী ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ করা হবে। বর্তমান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে জরুরী ভিত্তিতে ক্রোয়েশিয়ায় রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, কনস্ট্রাকশন কর্মী, কৃষিকাজের জন্য কর্মী এবং প্যাকেট করার কাজের জন্য কর্মী নেয়া হবে। ২ বৎসরের চুক্তি ভিত্তিক এই চাকরির জন্য কোম্পানি মাসিক বেতন দিবে প্রায় ৮০০ ইউরো।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে সবই অদক্ষ শ্রমিক। ইউরোপের প্রতিটি দেশেই বিদেশী শ্রমিকদের ভাষার জানার আবশ্যকতার উপর অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যারা ইউরোপে বসবাস করেন তারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে,এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি টি আসলে একটি সম্পূর্ণ ভূয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। সাধারনত দেখা যায়,এই রকম লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা নিরীহ লোকজনদের নিজেদের ফাঁদে ফেলে। পড়ে দেখা গেছে তারা প্রথমে বৈধ পথে পাঠানোর কথা বললেও শেষ পর্যন্ত অবৈধ পথেই পাঠিয়ে থাকে। নিজেদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রবাসে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখেন কিন্ত সেই স্বপ্ন পূরণ করতে যেয়ে অনেকেই দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েন। অনেক সময় অবৈধ পথে ইউরোপে আসতে যেয়ে রাস্তায় অনেকেই মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করে থাকেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে মানুষকে অবৈধ ভাবে ইউরোপে প্রবেশ করাতে লিবিয়া,মরক্কো ও তুরস্কের রুট ব্যবহার করা হয়। এইসব দেশের স্থানীয় দালালদের সাথে বাংলাদেশের দালালদের যোগাযোগ আছে। পুরো সিস্টেমটিই চলে একটি আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের চেইনের মাধ্যমে অর্থাৎ একহাত থেকে অন্যহাতে স্থানান্তর।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ইউরোপে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে নিম্নোক্ত তিনটি রুট দিয়ে দালালেরা মানুষদের ইউরোপে প্রবেশ করায়। অবৈধভাবে তিনটি পথে ইউরোপ ঢুকে মানুষ লিবিয়া, মরক্কো, তুরস্কো দিয়ে। লিবিয়া থেকে প্লাস্টিকের নৌকা করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার পথে গত কয়েক বৎসরে বাংলাদেশী সহ কয়েক শতাধিক অভিবাসী প্রত্যাশীর সলিল সমাধি হয়েছে ভূমধ্যসাগরে।
ইউটিউবে এইসব মর্মান্তিক ঘটনার ভিডিও ও নিউজ ফুটেজ এখনও দেখা যায়। এই পথে ইতালি তার সমুদ্র উপকূলে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং টহল বৃদ্ধি করায় এই রুটে ইতালি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ প্রায় বন্ধ। উত্তর আফ্রিকার দেশ মরোক্কো থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের আরেক প্রচেষ্টা চালায় দালালেরা। জানাজানি হওয়ার পূর্বে স্পিটবোর্ড দিয়ে মরক্কো থেকে স্পেনে কিছু লোক প্রবেশ করলেও এখন স্পেন তার সমুদ্র উপকূলে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও টহল জোরদার করায় এই রাস্তাও বন্ধ।
এই পথে সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীদের নৌকা বা স্পিটবোর্ড দেখলেই নিরাপত্তা কর্মীরা সরাসরি গুলিবর্ষণ করে। মরক্কোতে রয়েছে মাফিয়াদের এক ভয়ঙ্কর দালালচক্র। একবার দালালের খপ্পরে পড়ে কেও যদি মরক্কো আসে, বাস্তবতা দেখে যখন সাগরপথে না যাবার কথা বলে,দালাল তখন তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। মাফিয়ার দল তখন তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন করে দেশ থেকে টাকা আনাতে বাধ্য করে।
জানাগেছে,দেশ থেকে টাকা না আনতে পারায় অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। এইভাবে মানুষের জীবন নিয়ে চলে জাহেলী যুগের পৈশাচিক বর্বরতার খেলা। তৃতীয়ত তুরস্ক থেকে দালালেরা লোকজনদের সাদাখাল নামক নদী পার করিয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গল ও পাহাড় পর্বত পাড়ি দিয়ে গ্রীসে নিয়ে আসে। এই পথে আগত অভিবাসীদের ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা বিভিন্ন জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড়ী পথ দিয়ে হাঁটানো হয়। মাঝেমধ্যে ৫ থেকে ৭ দিন জঙ্গলে থাকতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে, দুই একবারের প্রচেষ্টায় গ্রীসে ঢুকা যায়। অন্যথায় ১০/১১ বারও লাগতে পারে। কেননা মাঝেমধ্যেই গ্রীস বা তুরস্কের পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কয়েকদিন রেখে আবার যেদিন থেকে এসেছে সেদিকে পাঠিয়ে দেয়। এই রুটে বিগত কয়েক বৎসরে অনেক বাংলাদেশী রাস্তায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
গ্রীস যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেষ সীমান্ত তাই গ্রীসের সীমান্ত দিয়ে যাতে অবৈধ অভিবাসী ইইউতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য এক চুক্তি মোতাবেক গত ১৮ নভেম্বর থেকে গ্রীস সীমান্তে ফ্রান্স,জার্মানি ও গ্রীসের যৌথ সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়োগ দিয়েছেন ইউরোপিয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশ থেকে আগত অভিবাসীদের এই রুটে প্রথমে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার কথা বললেও দালালরা বিভিন্ন কায়দায় ১৫ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে থাকেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও কয়েকটি ইউরোপের বাংলা অনলাইন পোর্টালে জানিয়েছেন কয়েকজন অভিবাসী।
অতীতে ইউরোপিয়ানরা তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসীদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হলেও বর্তমানে আর সেই রকম অবস্থানে নেই। বৈশ্বিক মহামারী করোনার জন্য বারবার লকডাউন ও কঠোর বিধিনিষেধের ফলে সমগ্র ইউরোপের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ দেশ এখন রিজার্ভ ও ইইউর ঋণের উপর চলছে। তাই এমতাবস্থায় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের মিথ্যাচারে প্রলুব্ধ হয়ে কেহ যেন অবৈধভাবে ইউরোপে না আসেন। আর কেহ যদি মনে করেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে ইউরোপে কোন রকমে ঢুকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা অন্য কোন উপায়ে থেকে যাবো,তাও এখন প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ দেশই এখন তাদের নিয়মকানুন অনেক পরিবর্তন করেছেন অবস্থার পরিপ্রক্ষিতে। কাজেই কোন কিছু না ভেবে ইউরোপে আসার জন্য কাউকে হুট করে টাকা না দেওয়াই উত্তম।
জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের(DW) বাংলা বিভাগ গত জানুয়ারী মাসে বলকান রাষ্ট্র বসনিয়া থেকে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। DW জানান,ইইউতে প্রবেশের আসায় বসনিয়ার জঙ্গলে কয়েক শতাধিক বাংলাদেশী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেন ইইউ প্রশাসন। ইইউর প্রচন্ড চাপে বসনিয়ার সেনাবাহিনী তাদের অস্থায়ী তাঁবুর ব্যবস্থা করলেও বসনিয়া সহ ইউরোপের কোন দেশই তাদের গ্রহণ করতে রাজি নন।
এদিকে সার্বিয়ার দৈনিক পত্রিকা “Besti”জানিয়েছেন,সার্বিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে প্রায় ২০০ শতাধিক বাংলাদেশী রয়েছেন। প্রথমদিকে সার্বিয়ার সরকার তাদের জন্য কিছু না করলেও ইইউ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিডিনিউজ ইউরোপ /৮ ফেব্রুয়ারী / জই