“স্নেহ, পরামর্শ, ও অনুশাসনে গড়া সুন্দর সম্পর্কের কৌশল”
কিশোর বয়সের বা বয়ঃসন্ধি কালের সন্তানদের নিয়ে অভিভাবক যেমন মানষিক দুশ্চিন্তায় থাকেন, তেমনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এই বয়সের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই বয়সী ছেলে-মেয়েরা একটু উগ্র মেজাজে থাকে। একা থাকতে ভালোবাসে কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেশি পছন্দ করে। তাই এই সময়টা তে ছেলে-মেয়েদের পথচ্যুৎ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণ পাওয়ার কিছু উপায় সংক্ষেপে উপস্থাপন করছি। একটা পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে স্ট্রং বন্ডিং থাকাটা খুব জরুরি। যেটাকে আমরা বলি সংঘবদ্ধ পরিবার। বাচ্চাদের সাথে সংঘবদ্ধতার অভাব যেই পরিবারে পরিলক্ষিত হয়, সেখানেই দেখা যায় বাচ্চারা মা-বাবার অবাধ্য। লেখাপড়ায় অমনোযোগী।এমনকি বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরে।
বাচ্চাদের খারাপ সঙ্গী এড়াতে কিংবা পথচ্যুৎ যেন না হয়,সে জন্য বাবা-মা / অভিভাকদের করনীয়ঃ
বর্তমান সময়ে প্রায় পরিবারের বাবা-মা উভয়ে কর্মজীবি।তাই বাচ্চাদের খুব বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। তারপরও রাতে যেহেতু বাসায় থাকা হয়, রাতের খাবারটা বাচ্চাদের সাথে একসাথে খাওয়া। বাচ্চাদের সারাদিনের কর্মকান্ড এবং বিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। বাচ্চাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে ঘরের টুকটাক কাজে নিয়োজিত রাখা। যেমনঃ নিজের বিছানা গুছানো, পড়ার টেবিল গুছানো, বাবা-মায়ের কাজে একটু সহযোগিতা করা, গাছে পানি দেয়া কিংবা ড্রেস গুছিয়ে রাখা বা ছোট ভাই-বোন থাকলে তাদের সময় দেওয়া।এতে করে বাচ্চারা ছোট বেলা থেকেই নিজেকে যেকোন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে। খারাপ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার চিন্তা মাথায় আসেনা। ঘরের টুকটাক কাজে তাদেরকে প্রশংসা করে উৎসাহিত করুন। বাচ্চারা কোন কাজের প্রশংসা শুনলে খুব আনন্দ পায় এবং সেই কাজ করতে আরো অনুপ্রানিত হয়।তাদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে উপহাস না করে,তাদের ভুল গুলো সংশোধন করার সুযোগ তৈরি করে দিন।
বাচ্চাদের সাথে অবশ্যই বন্ধুসুলভ হওয়া উচিৎ। বাচ্চাদের বিশ্বাস অর্জন করুন।তারা যেন কোন কিছু শেয়ার করতে দ্বিধা না করে।এই সময় বাচ্চারা সঙ্গ চায়। তারা যদি বাবা-মায়ের সাথে সব কিছু শেয়ার করতে না পারে তখন তারা পথচ্যুত হয়ে অনেক অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরে । আপনি হয়তো দেখছেন আপনার সন্তানটি হঠাৎ করে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছে, আপনার বেশিরভাগ কথাতে রিয়্যাক্ট করছে, অনেক সময় মিথ্যা বলছে কিছু নিয়ে, কোনো বিষয় লুকাচ্ছে, যেই বন্ধুদের সাথে হয়তো আপনি বলছেন কম মিশতে তাদের সাথেই বেশি মিশছে, তর্ক করছে কারণে অকারণে। একই বাড়িতে থেকে মানসিকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সন্তানের সাথে। পরিবার, মা-বাবা কিন্তু সন্তানের সবচেয়ে আস্থার জায়গা। এই কথাটি আপনার কিশোর বয়সের সন্তানের কাছে বোধগম্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুধু কথায় না বরং কথায় ও কাজের সংমিশ্রণে সন্তানকে এই ব্যাপারটি বোঝান। আপনার কিছু বন্ধু সুলভ আচরণই পারে আপনার প্রিয় সন্তানটির জীবনের এই কঠিন সময়টিকে সুন্দর করে তুলতে।
আপনি যদি আপনার কিশোর সন্তানকে আপনার কথা শোনাতে চান, তাহলে আপনাকেও কিন্তু তার কথা শোনার সময় ও ধৈর্য্য থাকতে হবে। আপনার কিশোর আচরণের অনুভূতির অভাবনীয় ব্যাপারগুলো কল্পনা করুন এবং ভাবুন যে আপনার কিশোর সন্তানটি কেমন অনুভব করছে, তাদের দৃষ্টিকোণ বুঝতে চেষ্টা করুন। যখন আপনি সন্তানদের অনুভূতিকে বুঝতে পারেন, তখন তারা বুঝতে পারে যে তাদের অনুভূতি, ধারণা এবং মতামতকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। আপনি চান আপনার কিশোর সন্তান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোক এবং সেই শ্রদ্ধা হোক ভেতর থেকে। তবে আপনিও তাদের সম্মান করে এই বিষয়টি শেখান। শুধু ভয়, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, সব শখ পূরণের ব্যবস্থা – কখনো সম্মান এনে দিতে পারে না। সন্তানের ব্যক্তিত্ব, ধারণা, মতামত এবং আবেগ অনুভব করুন এবং সম্মান দিন। তাদের বন্ধুদের সামনে, কেউ সামনে না থাকলেও তাদের নিন্দা করবেন না এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাদের মতামতকে তুচ্ছ বা সমালোচনা করবেন না। এতে তারা নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে পারে। যখন আপনি আপনার সন্তানদের অসম্মান করে কথা বলবেন বা আচরণ করবেন, তখন তারাও আপনার প্রতি একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিশোর বয়সের সন্তানের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে আপনাদের এই দিকগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে।
বেশিরভাগ কিশোর কিশোরী নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে পছন্দ করে এবং মনে করে কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তাদের জানা প্রয়োজন যে আপনি তাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক। তাদের যে কোনো প্রয়োজনে আপনি পাশে আছেন বন্ধুর মতো। সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপনি কখনো কঠোর হতে পারেন কিন্তু কঠোরতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সন্তান ভুল বুঝবে আপনাকে। আপনার অতিরিক্ত শৃঙ্খলা এবং কঠোরতা দেখে তারা বিশ্বাস করতে পারে যে আপনি শুধুমাত্র তাদের জন্য জীবনকে কঠিনই করতে চান। তাদের বলুন আপনি তাদের ভালোবাসেন এবং জীবনে শৃঙ্খলা থাকা দরকার সবারই।
আপনার সন্তানদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে এবং অনুশীলনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাদের যথেষ্ট সংখ্যক সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কিশোর বয়সের সন্তানের আচরণ নিয়ে যদি আপনার চিন্তা থাকে তাহলে অবশ্যই সন্তানের সাথে কথা বলুন। সন্তান কথা বলতে না চাইলে তাকে কিছুটা সময় দিন।
বাচ্চাদেরকে বাড়ির আঙিনায় তাদের নিজের হাতে কিছু গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা এবং সে গাছের যত্ন নেয়া৷ এতে করে গাছ তার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠবে। গাছকে সময় দিতে সে ভালোবাসবে৷ পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান, জার্নাল, উপন্যাস বা বিখ্যাত লেখকদের বই তাদেরকে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। এতে করে বাচ্চারা বইয়ের মধ্যে তার আনন্দ, ভালোলাগা খুঁজে পাবে। বাহিরের খারাপ জগতের কথা মাথায় আসবেনা। এ কাজ গুলো যদি আমরা করতে পারি বাবা-মা হিসেবে, ইনশাআল্লাহ আমাদের বাচ্চারা খারাপ জগতের সাথে পরিচিত হবেনা। দেশের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। বাবা-মা হিসেবে আমরা অন্তত এটুকু করতে পারি।
তাসলিমা বেগম
সহকারী প্রধান শিক্ষক
চরফ্যাসন সরকারি টি ব্যারেট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
চরফ্যাসন, ভোলা।
বিডিনিউজ ইউরোপ/২৩ অক্টোবর/জই/ভোলা