ছোটবেলার বাবার রবিঠাকুরের ফটো ও মায়ের বলিরেখা -সুজন দেবনাথ
প্রখ্যাত কবি,সাহিত্যক,প্রবন্ধকার ও দক্ষ কূটনৈতিক সুজন দেবনাথ বহুমাত্রিক একজন লেখক তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্মৃতিচারণ মূলক চমৎকার একটা লিখনি লিখেছেন সেই লিখনী টি আপনাদের জন্য তোলে ধরা হয়েছেঃ
ছোটবেলার বাবা
আমার ছোটবেলার বাবা সব জানতেন
সবকিছুতে সঠিক ছিলেন
একদিন বাবা পড়ালেন, অসৎসঙ্গ ত্যাগ করো–
আমি আর টিটোর সাথে খেলিনি
কারণ বাবা জেনে যাবেন, বাবা সব জানতেন
সেই বাবা হঠাৎ আমার চেয়ে কম জানতে শুরু করলেন
একদিন বাবা বললেন, মিথ্যা খুব খারাপ, কখনো মিথ্যা বলবি না
আমি বুঝলাম, বাবা অতো বেশি জানেন না
ততোদিনে জেনে গিয়েছিলাম, ভিখারী পয়সা চাইলে টাকা থাকলেও ‘নেই’ বলা যায়, ওরকম মিথ্যায় কিছু হয় না
বাবা সেই যে কম জানতে শুরু করলেন কম জানতে জানতে, একেবারে বোকাই হয়ে গেলেন
বাবা বলতেন –
রবিঠাকুরের ফটো নিয়ে সাঁতরে উত্তর পুকুর পার হতে পারলে
আমি রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাব
এ কথা এখন আর বিশ্বাস করি না
যতোদিন বিশ্বাস করতাম, ততোদিনই বড় হতে চাইতাম।রবীন্দ্রনাথ হতে চাইতাম
বাবা – তুমি কম জানতে শুরু করলে কেন?
আমি যে আবার বড় হতে চাই
বড় হবার জন্য
সেই সবজান্তা বাবাকেই চাই
যে বাবার ছেলে, বুক উঁচু করে বলে –
মিথ্যা বলা সত্যিই মহাপাপ
কারণ আমার বাবা বলেছেন, আমার বাবা সব জানেন
মায়ের বলিরেখা
একটি মেয়ে যুদ্ধ করছেন সূর্যের সাথে, অল্প বয়স থেকে সূর্যের সাথে কেউ জিততে পারে না, তিনিও পারেন নি।
তিনি জানতেন, হারবেন – তবু পথ ছাড়েন নি।
আমি সেই পথে পৃথিবীর সাথে পঁচিশটি সূর্য পার হয়ে
দেখি – তার মুখে অনেক যুদ্ধ-চিহ্ন, অনেক বলিরেখা।
মেয়েটি সূর্যের সাথে যুদ্ধ করেছেন, খুব অল্প বয়স থেকে এই যোদ্ধা মেয়েটিকে আমি মা নামে ডাকি, জন্ম থেকে।
মায়ের মুখের বলিরেখা আমার ভালো লাগে না, আমি আমার
শৈশবের মাকে চাই। মাঝে মাঝে শৈশব ছুঁতে খুব ইচ্ছে করে,
আমি মায়ের বলিরেখায় হাত বুলাই, বলিরেখায় আমার শৈশব
খুঁজে পেলেও, আমার শৈশবের মা নাই। মায়ের বলিরেখা আমার ভালো লাগে না, একদিন সূর্যকে বিশ্রী গালাগালি দেই।
সূর্য বলে, আমি নই, ওই সব বলিরেখা আসলে বানিয়েছিস তুই।
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না, মায়ের পেটের দিকে
তাকাতে পারি না – অপরাধী, চির-অপরাধী হয়ে রই।
মায়ের কোলে মাথা রাখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু
তার মুখের প্রতিটি বলিরেখা আমাকে আসামী করে দেয়,
মায়ের পেটের প্রতিটি দাগ আমাকে ফাঁসির রায় শুনায়।
বইঃ হোমার-সাগরে হিমালয়
সুজন দেবনাথ
চৈতন্য প্রকাশনী
বিডিনিউজ ইউরোপ/৮ ফেব্রুয়ারি/জই