• মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম
কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের নির্বাচনে সভাপতি মাহবুব,সহ সভাপতি কামাল, সম্পাদক মমতাজ ধনবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী ষাঁড়ের মই দৌড় দেখতে হাজির হাজারো মানুষ ধনবাড়ীতে নানা আয়োজনেরমধ্য দিয়ে কৃষক দলের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত ভোলায় র‍্যাবের অভিযানে ১২ মামলার আসামি আটক ১ যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্টের চোখে এবছর বিশ্বে ‘বর্ষসেরা দেশ’ বাংলাদেশ হাসিনা ও জয় ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমান উঠানামায় বিঘ্ন দীর্ঘ এক দশক পরে জনপ্রিয় “আমার দেশ” প্রকাশিত জার্মানিতে ক্রিসমাস মার্কেটের ভিড়ের মধ্যে গাড়ির ধাক্কায় নিহত ২ আহত অর্ধশতাধিক ধনবাড়ীতে মাশরুম চাষে আত্মকর্মসংস্থানের হাতছানি

মাহফুজুল আলম এর “গল্প সংকলন-১” গল্পঃ একজোড়া চুড়ির প্রতিবিম্ব

মাহফুজুল আলম ফ্লোরিডা (আমেরিকা)
আপডেট : বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

মাহফুজুল আলম এর “গল্প সংকলনঃ ১” ( পুস্তাকাকারে প্রকাশমান)

গল্পঃ একজোড়া চুড়ির প্রতিবিম্ব
( মাহফুজুল আলম এর গল্প সংকলন-১” নামে পুস্তক আকারে আগামী বইমেলায় প্রকাশিত হবে)

আমার স্ত্রী কিছু কিনে দিতে চান । কিন্তু তিনি নিতে চান না । ভাবেন, না জানি কত খরচ হয়ে যাবে । তিনি উসখুস করেন । আমার স্ত্রীও নাছোড়বান্দা, না নিলে কিছুতেই ছাড়বেন না । মেলা জমে উঠেছে । মেলাময় লোকে লোকারণ্য । কিছুক্ষণ আগে মাঝরী একহারা গড়নের আনুমানিক ৬০ বছরের এক প্রবাসী মা; মেলার ভেতর রকমারী জুয়েলারির দোকানের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছেন । কোন একজোড়া হাতের চুড়ির উপর গিয়ে চোখ আটকে গেছে । দোকানীর বুঝতে বাকি নেই ওটা খদ্দেরের পছন্দ হয়েছে । তাই দাম কত তা জানিয়ে ডেকে বসলো । সমস্যাটা তখনি শুরু । ছিটকে সরে পালাচ্ছিলেন তিনি । কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়ায় লজ্জায় অভিমানে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না । আমরা পেচিয়ে-ঘেচিয়ে তাঁর কোন এক আত্মীয়ের প্রতিবেশী । তাদেরকে সহযোগীতা ও নিজেরা মজা করতে একটি বাংলাদেশী রকমারী খাবার স্টলের নামে মেলায় দোকানদারী করছি । প্রবাস জীবনে এটা আমাদের সহ সকল বাঙ্গালীদের কাছেই বড় একটি মিলন মেলা বা উৎসব । সচরাচর বাঙ্গালীদের খুব একটা সামনা-সামনি দেখা হয় না ; নির্দ্রিষ্ট কিছু বাঙ্গালী দোকানে না গেলে ।

সম্পর্কের টানে আমার স্ত্রী তাঁকে ফুপু বলে ডেকে ভীষণ আবদারে ধমকাচ্ছেন এই বলে,
— “চুড়ি কিনে দিচ্ছি, নিতেই হবে ।”
প্রবাসে এলে প্রতিটি নেহায়েত ডাকও বুকের ভেতর হতে ঠিক সঠিক মাত্রার চেয়েও বেশী মাত্রায় বেরিয়ে আসে । যাঁদের ফেলে এসেছি বাংলাদেশে তাঁদের কথা ভেবেই ওটা হয় । আমার স্ত্রীর সাথে ফুফুর বাক্য ব্যয় চলছে । কে জয়ী হবেন বোঝা দায় ।

তিনি ফোর্টমায়ার্স-ফ্লোরিডায় প্রবাসী হয়ে এসেছেন তাঁর ছেলের কাছে । তাঁর ছেলে থাকেন এখান হতে প্রায় বাংলাদেশের যাতায়েত অনুযায়ী ১২ ঘন্টা বাস জার্নির পরিমাণ দূরের এক শহরে। ছেলেটা কিছুই করে না এখন । হয়তো বিদেশে স্ত্রীর কামাইয়ে বসে বসে খেলে জাত যায় না । নিজের একমাত্র বাচ্চাকে দেখাশোনা করে কাটে । মাকে দেশ হতে নিয়ে এসেছে । কিন্তু এই মা এখনো বিদেশে নিজেকে ওতোটা মানিয়ে নিতে পারেননি । কিন্তু এটা ঠিকই মেনে নিয়েছেন যে, নিজের কোন স্বাভাবিক চাহিদা মেটাতে সাধারণ ভাষায় চাইতে হয় । কিন্তু ছেলের বৌয়ের কামাইয়ে বসে বসে খেয়ে চাইতে পারবেন না । যদিও ছেলের বৌ কখনই তেমন আচরণ করেননি যে, সেটা খারাপ মনে হবে ।

ঢাকা ক্লাব উইন্টার ফেস্টিভাল অব ফ্লোরিডার আয়োজনে বসেছিল মেলা । আমার স্ত্রীর শেষ অস্ত্র আমি । কয়েকটি হাতিয়ার আমার বেশ রপ্ত করা আছে । তার মধ্যে একটি ছিল –
মেয়ে নয়, মাকে পটানো । স্কুল জীবন হতেই আমার মাথা ঘূন খেয়েছে । ঘূনটা হচ্ছে শরৎ বাবু । পোকাটা হচ্ছে শরৎ বাবুর উপন্যাসের প্রতিটি অসহায় নারী চরিত্র গুলো । তারপর হতেই এই অবস্হা । মায়েদের পা ধরে ঝুলে পড়ে থাকি আদর খাবার জন্য । আর ভাj ;লোবাসা এবং সন্মানে তাঁদেরকে বুকের অনেক ভেতরে এবং মাথার অনেক উপরে রেখে চলেছি ।

আমার স্ত্রী ফুফুকে শেষমেষ রাজি না করাতে পেরে আমার সামনে এসে টলমল চোখে দাড়ালেন । ফুফুর হাতের মলিন চুড়ি দু’টি তার সোনালী রং ছেড়ে চলে গেছে কবেই – তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে । আমার স্ত্রী সে রং ফিরিয়ে দিতে চান । আমার দৃষ্টি আমার স্ত্রীর চোখ ভেদ করে তার অন্দেরে পৌঁছে গেল এবং দেখতে পেলাম আমার শাশুড়ী সহ বেশ কতক মাতৃশ্রেনীয়াদের মুখ । ছোঁয়াচে রোগ বুঝি একেই বলে । আমি আক্রান্ত হলাম । এর কোন ঔষধ নেই, কেবল আছে পথ্য । সেটাই এখন কাজে লাগাতে হবে । নির্ভ্যাজাল জালের মায়াবী ফাঁদে আরো কতগুলো মুখ ভেসে উঠলো । নিজের মা-খালাদের কাছে আমাকে নিয়ে যে হুলস্থুল করা ভালোবাসা ছিল, তার জোয়ারে আমার মনের ভেতরে কি যেন একটা ধীরে ধীরে ভাঙ্গতে শুরু করলো ।

আমার স্ত্রীর হাতে মোটা মোটা পাঁচ জোড়া সোনালী ও রূপালী রংয়ের চুড়ি । সেই রং কিছুক্ষণ আগে তার মনের মধ্যে গিয়ে আলোর প্রতিবিম্ব ফেলেছিল । সেই আলোয় কয়েকটা পৌঢ় মায়েদের আলোকিত মুখ দেখতে চায় ।
আমার স্ত্রী আমার পানে নির্বিঘ্নে তাকিয়ে আছেন অসহায় বাক্যে । যেন শেষ ভরসায় পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার মত করে অধির আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন । এর মধ্যে আছেন আরো একজন। যিনি বড় বড় দুই শাবালক ছেলের মা। নিজের সন্তান হিসেবে একটি মেয়ে না থাকা মাতৃত্বে আমার স্ত্রীকে মেয়ে ডেকেছেন । সম্পর্কে কাছে টেনে নিয়েছেন ক’দিন আগে । সেজন্যই বুঝতে বাকি রইল না কি হচ্ছে আমার স্ত্রীর আবদারি অভিমানী মুখের পেছনে – মনের অন্দরে ।

আমি কিছুটা হেসে নিলাম । আমার স্ত্রী এবার প্রশ্রয় পেলেন । আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন মেয়েদের প্রসাধনীর স্টলের সামনে । বাকিরা কম-বেশী আমাদের আসে-পাশে আছেন । আমার স্ত্রীর অভিযোগ অনুযায়ী আমাকে আরো বেশী সুন্দর ও দামী অর্নামেন্ট দেখতে হলো । কারণ তার সন্দেহ হচ্ছিল, পাছে আরো বেশী দামী কিছু হলে হয়তো কাবু করা যাবে । তাকে খুশি করতে তাই করলাম । ঠিক তখন দেখলাম, আমার দুই ছেলের মা, আমার স্ত্রীর ভেতর বাঙ্গালী মায়ের চির সত্তা দারুণ করে খেলে যাচ্ছে । পৃথিবীময় মায়েদের চির সত্য এবং আমার বলা শরৎ বাবুর ঘূনেপোকার বিশাল মাতৃত্বের আঁকুতি ভরা তান্ডব দেখতে পেলাম । শেষে যা হবার তাই হলো । নিজ হাতে সকলের হাতে চুড়ি ওঠালেন আমার স্ত্রী।

আমি আমার মায়ের প্রতিবিম্ব দেখেছিলাম ক’জন বাঙ্গালী মায়ের আচরণে – সেদিনের সে ঘটনায় । আজ কিছুক্ষণ আগে আমার মায়ের সাথে কথা হচ্ছিল ভিডিও কলে । বাংলাদেশে বসে আমার মা আজ খুব ভারি ভারি করে আমার দিকে তাকায়ে আছেন । মনে হলো আমার মুখের পানে চেয়ে কেমন যেন বোকা বোকা আকুলতা । বুঝলাম আমি যাই বলছি তাঁর তা-ই ভালো লাগছিল । হয়তো তাঁর বুকের মধ্যে আমার চেয়েও বেশী পরিমাণ ভাঙ্গতে শুরু করেছে ।

কিছুক্ষণ আগে ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছিল । বড়ভাইয়া বললেন, “আম্মা অসুস্থ”। তাই হয়তো আমার পানে শিশুর মত তাকিয়ে আদর খুঁজতে লাগলেন । আমি আমার মাকে ছোট্ট মেয়ের মত আদর করতে না পেরে বিভিন্ন ভাবে হাসাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম । এমনিতেও তিনি আমাকে দেখলেই কেঁদে ফেলেন । প্রবাস জীবনের সাত বছরে গত বছর এক মাসের জন্য বাড়িতে ছিলাম । এখন আবার প্রবাসী । আমার চোখ হঠাৎ আমার মায়ের হাতে থাকা মোবাইলের ভিডিও কলে কিছু একটা দেখে আটকে গেল । আমি আমার মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে আছি । এখন আমাকেও হয়তো বোকা বোকা লাগছে । জানি না কতটা সময় এভাবে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সময় পার করেছিলাম । কেউ কথা বলছি না, শুধু তাকিয়ে আছি । আমার বুকের মধ্যে পুড়ে যাচ্ছিল । কত কাল নিজের হাতে কোন চুড়ি কিনে দেইনি । হাজার থাকুক তাঁর কিন্তু নিজের চাহিদা এখানেই সীমাবদ্ধতায় আটকে গেল ।

মায়েরা বুঝি এমনই হয়। হয়তো তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমাকে পড়ে ফেলেছিলেন । হঠাৎ তাঁর হাত হতে মোবাইলটা পড়ে গেল। সবাই তার মাথায় পানি দেওয়া ও অন্যান্য তদারকির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শুনতে পাচ্ছি । মোবাইলটার কথা কারো খেয়াল নেই । তখনো আমি ঐ ঘরের ভেতরের সিলিং ফ্যানের অবিরাম ঘূর্ণিপাক দেখতে পাচ্ছিলাম । আর আমার বুকের ভেতরের ঘূর্ণিপাক তারচেয়েও লক্ষগুণ জোরে ঘুরেই চলছে ।
বিডিনিউজ ইউরোপ/২ ডিসেম্বর/ জই


আরো বিভন্ন ধরণের নিউজ