ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন মাসুদ পেজেশকিয়ান ।ইরানের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মাসুদ পেজেশকিয়ান ফিরতি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন।শুক্রবার (৫ জুলাই) ইরানের দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর রক্ষণশীল সাইদ জালিলিকে হারিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থি হিসাবে পরিচিত মাসুদ পেজেশকিয়ান। তিনি ইরানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির নবম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন।তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি, এক সময়ে যিনি পরমাণু নিয়ে দরকষাকষি করতেন সেই সাঈদ জলিলিকে পরাস্ত করেছেন এবং তাঁকে সমর্থনের জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পেজেশকিয়ান পশ্চিমের সঙ্গে আরও নিবীড় ভাবে আলোচনা করার, দেশের কঠোর হিজাব আইন শিথিল করার এবং ২০১৫ সালের পরমানু চুক্তি পূনর্বহাল করার প্রতিজ্ঞা করেছেন।তবে বলা হচ্ছে এ নিয়ে বহু ইরানি সন্দিহান যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি যেহেতু রাষ্ট্রের সকল ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করেন এবং খামেনির চারপাশে কট্টরপন্থিরা রয়েছে, ৬৯ বছর বয়সী হৃদপিন্ডের (হার্টের) এই শৌল্য চিকিৎসক তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম ভয়েস অফ আমেরিকা তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়,গাজা ভূখন্ডে হামাস ও হেজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ এবং তেহরানের ইউরেনিয়াম পরিশোধন অস্ত্র-মানের কাছাকাছি চলে আসার আশংকার মধ্যেই পেজেশকিয়ানকে তাঁর সীমিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
ইরানের কর্তৃপক্ষ বলছে যে পেজেশকিয়ান ১ কোটি ৬৩ লক্ষ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ভোট। ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বলছে যে মোট ৩ কোটি লোক এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। শুক্রবারের এই ভোটগ্রহণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন পর্যবেক্ষক ছিলেন না। দেশের অভ্যন্তরের পর্যবেক্ষকরা বলেন বহু ভোট দাতাই ভোট দিতে আসেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মুখপাত্র ভয়েস অফ আমেরিকার ফার্সি বিভাগকে বলেন যে ইরানের নির্বাচন “ অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল না” এবং “ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইরানি এতে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন”।
মুখপাত্রটি বলেন, “ আমাদের এমন কোন প্রত্যাশা নেই যে এ ধরণের নির্বাচন ইরানে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনবে কিংবা তার জনগণের মানবাধিকারের প্রতি কোন রকম সম্মান জানাবে। যেমনটি প্রার্থীরা নিজেরাই বলেছেন ইরানের নীতিমালা ঠিক করেন সে দেশের সর্বোচ্চ নেতা”।
মুখপাত্রটি আরও বলেন, “ এই নির্বাচন ইরানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাবও ফেলবে না। ইরানের আচরণ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ অপরিবর্তিতই থাকছে। যখন আমেরিকান স্বার্থের প্রশ্ন আসে আমরা তখন কুটনীতির দিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকি”।
ভয়েস অফ আমেরিকার ফার্সি বিভাগে পাঠানো ভিডিওগুলিতে ভোট কেন্দ্রগুলি জনশূণ্য দেখা যাচ্ছে এবং বহু প্রত্যক্ষদর্শী এবং ইরানের নাগরিক সাংবাদিকরাই জানিয়েছেন যে ভোট দাতাদের সংখ্যা ছিল খুব কম। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, পেজেশকিয়ান এমন একটি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে জিততে সক্ষম হয়েছেন – যারা মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ জনগোষ্ঠী বলে ধারণা করা হয়।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির উত্তরসূরি নির্বাচনের এই দ্বিতীয় পর্বে তেহরান, আহওয়াজ ও রাশ্তসহ কোন কোন শহরে ইন্টারনেট অচল থাকার খবর পাওয়া গেছে।কোন কোন সামাজিক মাধ্যম অনুমান করে যে জনশূন্য ভোট কেন্দ্র সম্পর্কিত ছবি ও খবর যাতে প্রকাশ করা না হয় সে জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বলে প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা গেছে শুক্রবারের এই ভোটগ্রহণে ৫০% ভোটদাতা অংশ নেন যা জুন মাসে প্রথম দফা ভোটগ্রহণের চেয়ে বেশি ছিল।ওই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম দফার ভোটদানে প্রায় ৪০% লোক অংশ নেন যা ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে এই অবধি ছিল সর্বনিম্ন।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ইউনাইটেড আগেইনস্ট ইরান গোষ্ঠীর কাসরা আরাবি বলেণ, “ অংশগ্রহণকারীদের সংখ্য কম হওয়া সত্ত্বেও বাইরের লোকদের কাছে ভুয়া প্রতিযোগিতার একটি কল্পিত চিত্র তুলে ধরতে খামেনি তূলনামূলক ভাবে সফল হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বলছে যে ইরানের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নয় কারণ ইরানের শাসকরা খামেনির প্রতি বিশ্বস্ত নন এমন প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করেন।
আরাবি বলেন পেজেশকিন ও জালিলির মধ্যে “ কোন অর্থবহ পার্থক্য নেই “কারণ সব ধরণের কৌশলগত নীতি নির্ধারণ করেন খামেনি”।১৮ বছর বা তারচেয়ে বেশি বয়সের ৬ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটদানে যোগ্য ছিলেন। এই ভোটগ্রহণ শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হবার কথা ছিল কিন্তু এতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য সময়সীমা মধ্যরাত অবধি বাড়ানো হয়।উল্লেখ্য যে,গত মে মাসে এক হেলিকপ্টার দূর্ঘনায় রাইসি নিহত হন। তাঁকেই খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মনে করা হতো।
কে এই মাসুদ পেজেশকিয়ান ?
মধ্যপন্থি মাসুদ পেজেশকিয়ান স্বল্প পরিচিত একজন আইনপ্রণেতা ও কার্ডিয়াক সার্জন।ইরানের লাখ লাখ মানুষের সামাজিক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নানা ধরনের প্রত্যাশার কেন্দ্রে আছেন পেজেশকিয়ান (৬৯) । তার জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের মাহাবাদ শহরে।
হাই স্কুল শেষে প্রথম ডিপ্লোমা অর্জনের পর পেজেশকিয়ান সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। তার পোস্টিং হয় ইরানের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় শহর জাবোলে। এখানে থাকাকালেই তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানে দ্বিতীয় ডিপ্লোমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৬ সালে তাব্রিজ মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
পেজেশকিয়ান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং জেনারেল সার্জারির বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ১৯৮০-র দশকে ইরান–ইরাক যুদ্ধে অংশ নেন ও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসাকর্মীদের মোতায়েনের দায়িত্ব ছিল তাঁর।
১৯৯৩ সালে তিনি ইরান মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি পান। পরে তিনি হার্ট সার্জারির বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি পাঁচ বছর তাব্রিজ মেডিকেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
১৯৯৪ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও এক সন্তান হারান। পরে আর বিয়ে করেননি। দুই ছেলে ও অপর এক মেয়েকে নিয়েই থাকেন তিনি। ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অষ্টম পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো আইন পরিষদ মজলিশের সদস্য হন। এরপর থেকে আইনপ্রণেতা হিসেবে বিভিন্ন পার্লামেন্টে ছিলেন তিনি। তিনি সংখ্যালঘু আজেরি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার।
দশম পার্লামেন্টে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। চলতি বছরের প্রথম দিকে সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তিনি মজলিশের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন পূর্ব আজারবাইজানের প্রাদেশিক রাজধানী তাব্রিজ থেকে।
এর আগে দুইবার তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমবার ২০১৩ সালে ইরানের সাংবিধানিক কাউন্সিলের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে প্রয়াত আলি আকবার হাশেমি রাফসানজানির পক্ষে নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন। দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেবার সাংবিধানিক কাউন্সিল তাকে মনোনয়ন দেয়নি।
চলতি বছর মাসুদ পেজেশকিয়ান ‘ন্যায়বিচার’ নামের একটি প্লাটফর্ম থেকে ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান। তাদের শ্লোগান ছিল ‘ইরানের জন্য ঐক্য ও সংহতি’।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের তীব্র টানাপোড়েনে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে বের করবেন পেজেশকিয়ান।
তিনি ইরানকে বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে স্থগিত আলোচনায় উত্তেজনা প্রশমন এবং সামাজিক উদারীকরণ ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদের সম্ভাবনা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
bdnewseu/7July/ZI/Iran