দুই উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ‘কথা বলো নারী’ সংগঠনের যাত্রা
রোকেয়া স্মরণে “সুলতানাদের স্বপ্ন ২০২৪” শীর্ষক এক মতবিনি ময় সভায় ‘কথা বলো নারী’ সংগঠনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। জুলাই অভ্যূত্থানের পরপর এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে।আজ ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, বিকেল ৪ টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামলী শীল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দো লনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা।সভাপতিত্ব করেন ‘কথা বলো নারী’র আহ্বায়ক নুসরাত হক। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ‘কথা বলো নারী’র সংগঠক আইরিন আক্তার ও আবদুর রহমান নবীন।
মতবিনিময়ে আলোচনা করেন শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা, উন্নয়নকর্মী, ব্যাংকার, আইনজীবী, ডাক্তার, অভিভাবকবৃন্দ।আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার বলেন, ইতিহাসে নারীর ভূমিকা সর্বদাই অবহেলিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা বা বীরত্বগাঁথা অপ্রচারিত। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে সকল অপপ্রচার, অনলাইন বুলিং রুখে দিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও নারীর ভয়েস উপেক্ষিত, নারী শহীদ হলেও সেটা স্বীকার পর্যন্ত করে না অথচ পুরুষ আন্দোলনকারীরা একেক জন উপদেষ্টা। নারীদের নিজেদেরই নিজেদের কথা বলতে হবে, সকল সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করতে হবে, সমান সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আদিবাসী শিক্ষার্থী আদিপার বম বলেন, সকল নারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি যাদের অবদানের কারণে নারীরা আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছেন ইনক্লুডিং বেগম রোকেয়া। পাহাড়ে নারীদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুরবস্থা, পাহাড়ি নারীরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ঢাকা শহরে সকল এডুকেশনাল ইন্সটিটিউটে আদিবাসী নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি বুলিংয়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আদিবাসীদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। আদিবাসীদের শিক্ষার সুযোগ বর্ধিতকরণ, আদিবাসীদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার সহিত শিক্ষার সুযোগ দান, পার্টটাইম চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, পাহাড়ে নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসান আবশ্যক এবং এ বিষয়ে সমাজ ও সরকারের নজর দরকার। সমাজে নারী ও পুরুষের গুরুত্ব সমান; কাউকে বাদ দিয়ে সমাজ এগিয়ে যেতে পারবে না।
মেডিক্যাল শিক্ষার্থী উম্মে ইরফাত জাহান বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হাজারো নারীর বজ্রকণ্ঠ কেন হারিয়ে গেল যা দ্বারা বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত ছিল! নারীরা ট্রাফিক পুলিশ হিসেবেও কাজ করেছে। নারীরা কেন হারিয়ে গেল? অথচ নারীরা তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের যা কিছু ছিল তা নিয়েই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। আন্দোলনকালীন পুলিশের হয়রানির শিকার হলেও নারীরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, পুলিশের হয়রানির ভয়ে আজিমপুর থেকে ভোর ছয়টায় আন্দোলন করার জন্য হেঁটে বা রিকশায় করে মিরপুর ১০-এ যাতায়াত করেছি। আন্দোলন এখনো শেষ হয় নি। নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যতীত এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমাকে দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দেখতে চাই। নারীরা শুধু কথা বলবে না, বরং এগিয়ে যাবে লড়াইয়ে-সংগ্রামে। বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা বাসরীন রহমান জানান, ম্যাটারনিটি লিভকালীন ব্যাংকে নারীর প্রতি প্রমোশনে বৈষম্য করা হয়। সমাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান সত্ত্বেও নারীকে সর্বদা উপেক্ষিত হতে হয়।
দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সোনিয়া রহমান খান বলেন, বাল্যবিবাহ এখনো সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। সন্তান ধারণে নারীর মতামতের গুরুত্ব নেই। প্রবাসে নারীরা সম্ভ্রমহানির শিকার। গর্ভধারণে নারীর মৃত্যু থেমে নেই। জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি আরও বলেন আমার চাওয়া নারী-পুরুষ সমান অধিকার, অস্বাভাবিক মৃত্যুর অবসান।
উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার তাহমিনা শৈলী জানান, আন্দোলনকালীন রাস্তায় গ্রাফিতি এঁকে বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। নারীর কাজই নারীর শক্তি। কক্সবাজারে নারীদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, নারীদের মজুরি স্বল্প, জীবিকার সুযোগ নেই, নারীর নামে পাশ হওয়া ফান্ড পুরুষরা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেন। নারীরা পরিশ্রমের তুলনায় বিন্দুমাত্র সুবিধা পান না। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং এ সমস্যার সমাধান দাবি করেন তিনি।
প্রকাশনা শিল্পে কর্মরত লাবণী মণ্ডল বলেন, শুরু থেকেই আমাদের বসবাস ক্যান্সার আক্রান্ত সমাজে, সব সেক্টরেই এখনো বৈষম্য পুনর্বহাল রয়েছে এবং লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। প্রকাশনা শিল্পে নারীর কাজের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, দালালদের প্রভাবে নারীদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। প্রকাশনা শিল্প, সংস্কৃতি নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। প্রকাশনা শিল্পে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, চিন্তাভাবনায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের সংগঠক মৌমিতা নূর বলেন, আন্দোলনে প্রশাসনের রক্তচক্ষু এড়িয়ে রাজপথে অবস্থান করে নারীদের চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।আন্দোলনরত নারীদের হেয় করা হয় কেন? ৫ আগস্টের পর থেকে নারীকে কেবল নারী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে অথচ আন্দোলন করার সময় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। শিক্ষার সহজলভ্যকরণ, নারীদের শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, প্রতি ঘরে ঘরে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন আবশ্যক।
আইনজীবী মারিয়া তানজিমা বলেন, এখনো নারীর বিয়ের বয়স নিয়ে বিতর্ক, নারীর স্বাস্থ্য অবহেলিত অথচ বেগম রোকেয়া বহুকাল আগেই বলেছেন নারীর বিয়ের বয়স ২১ হওয়া উচিত। বেগম রোকেয়ার চিন্তার প্রতিফলন এখনো পূর্ণরূপে ঘটে নি। এখনো পরিবারের গণ্ডিতেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। ফলে নারী কোটার যৌক্তিকতা পুনর্বিবেচ্য। নারীর অর্নামেন্টাল প্রেজেন্টেশন নয়, নারীকে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে হবে।পিএইচডি গবেষক খাতুন ই জান্নাত বলেন, আন্দোলনকালীন সময়ে কর্মস্থলে শোকজের হুমকিপ্রাপ্ত হয়ছি। আন্দোলনের পরে নারীরা কেন পিছিয়ে গেল? ফ্যাসিস্ট গিয়েছে ফ্যাসিজম নয়। নারী পরিচয়ে কর্মক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নারীকে নারী পরিচয় নয় তার কাজ ও যোগ্যতা দিয়ে বিবেচনা করা হোক। কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে।
আন্দোলনকারী অভিভাবক মণিষা মাফরূহা বলেন, আন্দোলনে মা, শিক্ষিকাদের অংশগ্রহণ ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বক্ষেত্রে নারীর লড়াই সর্বজনীন ও অনিবার্য। নারীদের সব প্ল্যাটফর্ম একত্র করে কাজ করলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য সফল হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী স্নেহা বলেন, সকল বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছি। মা’দের অসীম সাহস সন্তানদের খুব অনুপ্রাণিত করেছে। নারী নয় নিজেকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারীর কন্ঠস্বর দমনের প্রয়াস রুখে দাঁড়াতে হবে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর মোহাম্মদ বলেন, আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতার দলিল, ডকুমেন্টেশন খুব জরুরি। বৃহদাকারে নারীদের সংগ্রামের ভিডিও চিত্র ডকুমেন্টারি তৈরি করতে চাই, একাজে সকলের সহযোগিতা চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। অভ্যুত্থানের সকল অংশীদারদের (পেশাজীবী) ভয়েস কোথায়! নারীরা সৎ ভাবে অংশ নিয়েছিল তাই হয়তো হারিয়ে গিয়েছে। আন্দোলনে মেয়েদের ভ্যানগার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন পুলিশ হামলা না করে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ফ্র্যাটারনিটি পুরোটাই মেল ডমিনেটেড। নারীকে আদারিং করার প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জেন্ডার স্টাডিজ সর্বজনীন করতে হবে। নারীর প্রতি পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন জরুরি। নারীদের প্রতি সাইবার বুলিংয়ের প্রতিকার করতে হবে আবশ্যকভাবে সরকারি উদ্যোগে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শ্যামলী শীল বলেন, নারীরা নিজেদের দাবিতে নামছে না, স্টেক ক্লেইম করে না তাই নারীদের ভূমিকা অবহেলিত। নারী সংক্রান্ত বিষয়ে পুরুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ আবশ্যক। কেননা নারী মুক্তি মানেই সমাজ, দেশ, দশের তথা পুরুষের মুক্তি। নারীর অংশগ্রহণ নয় কেবল নেতৃত্বই যেকোন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফলতা আনতে পারে। নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্তির জন্য রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইন ও সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের জন্য আইন ও বাস্তবায়ন দরকার।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, এখনো পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব সর্বত্র বিরাজমান। যে গতিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসন চলছে তাতে ফল পেতে আরও ২৫০ বছর লাগবে। নারীকে যেখানেই দায়িত্ব দেয়া হোক, নারী সেটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সততার সাথে পালন করবে। একাত্তরের পর যেভাবে নারীদের অবদান হারিয়ে গেছে সেটা প্রতিহত করতে হলে নারীকে অবশ্যই কথা বলতে হবে। সংগ্রামের দীর্ঘপথ বাকি এখনো। নারীদের সাইবার বুলিংয়ের প্রতিকারে কী কী নীতি ও পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে নারীদের মতামত আহ্বান করেন তিনি।
উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ বলেন, “কথা বলো নারী”র শিরোনাম দারুণ। অবদমনের ফলে নারী কথা বলা ভুলে গেছে। নারীদের হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। আন্দোলনেকারী নারীদের ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার আবশ্যক কারণ প্রত্যেক দলই সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট। দলের অভ্যন্তরে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা দেখা যায় না।
“কথা বলো নারী”র আহ্বায়ক নুসরাত হক বলেন, বয়স কম হলেও জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে। সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্যই “কথা বলো নারী”র উত্থান। এ বিষয়ে সকলের সহায়তা কাম্য।
Economist/17December/ZI/Politics