গ্রিসের পূব কোনায় একেবারে তুরস্কের পেটের মধ্যে একটি দ্বীপ আছে। নাম লেসবস। এই লেসবস থেকে ইংরেজি ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে। এই শব্দটি চালু হবার গল্পটি অদ্ভুত। লেসবস দ্বীপে শাপো নামে অসীম প্রতিভার অধিকারী এক নারী কবি ছিলেন। পুরুষরা তার প্রতিভাকে হিংসা করত। শাপো ভালবাসার কবিতা লিখতেন। পুরুষরা বলতো, সেগুলো নাকি এক মেয়ে অন্য মেয়ের প্রতি ভালোবাসার কবিতা। তারা শাপোকে বলতো লেসবসের শাপো। লেসবসের শাপো থেকে হয়ে যায় লেসবিয়ান শাপো। ইংরেজিতে এই শব্দটিই নেয়া হয়েছে।
‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’-এ সেই ঘটনা এভাবে এসেছেঃ
এথেন্সের গণতন্ত্রের এক নম্বর নেতা ‘পেরিক্লিস’ আর সময়ের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী নারী ‘আসপাশিয়া’ গল্প করছে। গল্পের বিষয় গণতন্ত্রের জন্ম কীভাবে হলো। গল্পের ফাঁকে হঠাৎ আসপাশিয়া একটি কবিতা বললো,
“রক্তরাঙা মিষ্টি এক আপেল
রয়ে গেছে সবচেয়ে উঁচু ডালে
চেয়েছে অনেকে, পায়নি নাগালে
আজো অনাঘ্রাত, নিবে কি তুলে?
আসপাশিয়া মিষ্টি করে কবিতাটি বললো। এটি লিখেছেন লেসবস দ্বীপের নারী কবি শাপো। আসপাশিয়া খুবই আবেগ দিয়ে কবিতাটি বলছে। বার বার বলছে, যেন পেরিক্লিস বুঝতে পারে কবিতার এই অনাঘ্রাত আপেল আসপাশিয়া নিজে।
পেরিক্লিস বুঝার চেষ্টা করছেন। এটি একটি বিখ্যাত কবিতা। প্রেমের জন্য খুবই ভাল। যুবকদের মুখে প্রায়ই শুনা যায় কবিতাটি। তবে এই মুহূর্তে কবিতাটি নিয়ে ভাবছেন না পেরিক্লিস। তিনি ভাবছেন কবিকে নিয়ে। এই কবিতার নারী কবি শাপোকে নিয়ে অনেক কানাঘুষা আছে। তাকে নিয়ে গুজবের শেষ নেই। মেয়েরা কিছু লিখলে সেটা নিয়ে এমনিতেই আলোচনা, সমালোচনা হয়। আর কোনো মেয়ে যদি প্রেম নিয়ে লিখে, সেটা নিয়ে পুরুষের কেমন জানি লাগে। তারা কানাঘুষা শুরু করে, কানাঘুষা থেকে তৈরি হয় গুজব। এই কথা কবি শাপো জানতো না। সে মেয়ে হয়েও প্রেমের কবিতা লিখেছে। একটা দুটা না, পুরো এক বই প্রেমের কবিতা।
শাপোর কবিতার বই প্রকাশের সাথে সাথেই শুরু হলো আক্রমণ। একটি মেয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছে। মেয়েরা প্রেমের কবিতা কেন লিখবে? প্রেমের কবিতা লিখবে পুরুষেরা। পুরুষেরা মেয়েদের দেখে প্রেমের কবিতা লিখবে। প্রেমের কবিতা শুধুই মেয়েদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়। তো কবি শাপো প্রেমের কবিতা লিখেছে, মানে সে মেয়েদের উদ্দেশ্যেই লিখেছে। তার মানে তার কবিতা হলো মেয়ের প্রতি মেয়ের প্রেম। ছিঃ ছিঃ, শাপো এত খারাপ? সে মেয়ে হয়ে মেয়েদের উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা লিখে? সে মেয়েদের ভালোবাসে? কেউ জানতে চাইল না, শাপো কার জন্য এই কবিতা লিখেছে। সবাই বললো, কবি শাপো ছেলেদের ভালোবাসে না, সে মেয়েদের ভালোবাসে। কবি শাপোর যেখানে বাড়ি, সেই দ্বীপের নাম লেসবস। লেসবস দ্বীপের নাম থেকে মেয়ের সাথে মেয়ের প্রেম বিষয়টির নাম দিল লেসবিয়ান।
ব্যাপারটা ভাবতেই মাথা ধরে যাচ্ছে পেরিক্লিসের। মানুষ এত খারাপ? তারা মেয়েদের কবিতাও লিখতেও দিবে না। মেয়েরা কবিতা লিখলেই গ্রিসে নিন্দা হয়। সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত গ্রিসে কোন মহিলা কবি নেই। ভদ্র মেয়েরা কবিতা থেকে দূরে থাকে। তারা কবিতাকে ভয় পায়।
আসপাশিয়ার মনে হয় এই ভয় নেই। সে কী সুন্দর করে কবিতাটি আবৃত্তি করছে। পেরিক্লিস যখন শাপোকে নিয়ে ভাবছিল, সেই ফাঁকেও আরো একবার কবিতাটি আবৃত্তি করে ফেলেছে।
আসপাশিয়া বললো, এই কবিতার অনাঘ্রাত আপেল কে জানেন?
‘কে?’
‘এথেন্স। আপনার ভালোবাসার এথেন্স। আমি জানি আপনি এথেন্সকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। গণতন্ত্রকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।’ কথা মিথ্যা নয়। পেরিক্লিস এথেন্স আর গণতন্ত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। পেরিক্লিস এবার গণতন্ত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এই মেয়ে তাকে নাচাচ্ছে। কিন্তু কেন যেন নাচতে তার ভালো লাগছে।
আকাশে অনেক তারা। পেরিক্লিস জানালা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছেন। রাতটা বড়ো সুন্দর। একটু আগেই আসপাশিয়া এই রাতকে বলেছে ‘গণতন্ত্রের চাদরের উপর নির্ঘুম রাত’।”
[ যারা বেশি জানতে চায় তাদের জন্য বলছি – শাপো সক্রেটিসের এক প্রজন্ম আগের কবি। তার মৃত্যু হয় খ্রি.পূ. ৫৭০ অব্দে, আর সক্রেটিসের জন্ম খ্রি.পূ. ৪৬৯ অব্দে।
সক্রেটিস আর আসপাশিয়া সমবয়সী ছিলেন। তবে সক্রেটিস আসপাশিয়াকে তার গুরু বা শিক্ষিকা বলতেন।]
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/৩০ সেপ্টেম্বর/জই