‘১৪ ফেব্রুয়ারির অঙ্গীকার’ -হাসিব আহমেদ
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৩ সালে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল ও স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের দুর্বার আন্দোলনে ওই দিন শহীদ হয় জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, আইয়ূব, দীপালি সাহা সহ নাম না জানা অনেকে। আহত হয় শত শত ছাত্র-জনতা। গ্রেফতার করা হয় তিন হাজারের বেশি আন্দোলনকারীকে।
স্বৈরাচারী এরশাদ সেদিন দমন-পীড়ন, গুলিবর্ষণ, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস ইত্যাদির মাধ্যমে চেষ্টা করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে দমন করার জন্য। সেদিন থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে ছাত্রসমাজ পালন করে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।
৫২’র ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী পাকিস্তান সাময়িক জান্তা আইয়ুব খানের সাময়িক শাসনের বিরদ্ধে ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সবগুলোই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এক একটি সংগ্রামের সোনালি পালক। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জনগণের এই প্রতিবাদী চেতনাকে রুদ্ধ করতে শাসকশ্রেণি নানা সময়ে নানা কৌশলের আয়োজন করেছে। জনগণের পক্ষের শক্তি না হয়ে বরং নিজেদের স্বার্থে সংবিধান রচনা ও সংশোধন করে আসন মজবুত করার চেষ্টারত থাকেন। তাই ক্ষমতার মসনদ দখলের এই নিষ্ঠুরতম খেলায় স্বাধীনতার অবব্যহতি পরেই পরিলক্ষিত হয় সামরিক অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের।
১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ রক্তপাতহীন এমনই একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় বসেন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ছাত্রদের ওপরে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপরে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরে দমননীতি চালাতে থাকে। ছাত্ররা ২৪ শে মার্চেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল আলী।
এরশাদ ক্ষমতাসীন হবার পর ১৯৮২ সালে তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান বৈষম্যপূর্ণ পুরোনো ধ্যানধারণাপুষ্ট শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। এই নীতিতে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধিতা করে। কার্যত এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রসমাজ-শিক্ষকসমাজ ও দেশবাসী সেই মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তখন তেমন কোনো জোরালো দাবি না উঠলেও তৎকালীন ছাত্রসমাজ একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলো।
রাজনৈতিক অঙ্গনটা আস্তে আস্তে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে সচল হওয়ার চেষ্টা করে এবং ছাত্র সংগঠনগুলো মিলে দশ দলীয় ছাত্র ঐক্য নামে একটি জোট গঠন করে। এরপর তিন দফা যথা মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি ও সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
তিন দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, জীবন বাজি রেখে সমবেত হয়েছিল লক্ষাধিক ছাত্র-জনতা। সেখান থেকেই সচিবালয় অভিমুখে শুরু করে শান্তিপূর্ণ মিছিল। সেই মিছিলের ওপর এরশাদের ঐ অবর্ণণীয় হামলা হয়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। শহীদ হয় জয়নাল, দিপালী সাহা। শিশু দিপালীর লাশ গুম করে ফেলা হয়। পরে লাশের হদিস পাওয়া যায় নি। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরো অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থায়ই পাওয়া যায় নি।
তাদের রক্তের ধারাবাহিকতায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো নয় বছর সংগ্রামের পর ডাঃ মিলনের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন ও অনানুষ্ঠানিকভাবে এরশাদের পতন হয়। মাঝে ১০ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা নিপাত ও গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে নূর হোসেনকে জীবন দিতে হয়।
আমরা নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের ৩০ বছর অতিক্রম করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দারপ্রান্তে। কিন্তু এ উৎসব স্বস্তির না হয়ে পরিণত হচ্ছে বিষাদে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নামে বাকস্বাধীনতা হরণকারী আইন কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘদিন কারাগারে কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মোস্তাক। ফেনী নদী সহ আন্তর্জাতিক সকল নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, অসম বানিজ্য চুক্তি ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় টর্চার সেলে নির্মম মৃত্যু হয়েছে আবরার ফাহাদের। ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা বেড়ে ১৮৮ জন।
দেশের যখন এই হাল তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত হয় ভালোবাসা দিবস হিসেবে। ১৯৯৩ সালে সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন ‘ভালোবাসা দিবস’। স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস ও ভালোবাসা দিবস কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয় নয়। চাপিয়ে দেওয়া বিদেশি সংস্কৃতির খপ্পরে পড়ে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বিপ্লবী বীরদের ভুলে যাওয়ার যে রোগ আমাদের পেয়ে বসেছে তার সঙ্গে যেকোনো স্বাধীনচেতা মানুষেরই তর্ক থাকা উচিত। তাই ভালোবাসা দিবসের উচ্ছ্বলতায় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের চেতনা যেন হারিয়ে না যায়। বরং সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার যে অমরকীর্ত গড়েছেন তার মহিমায় ভাস্বর হয়ে কাঞ্চন, দিপালী, জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল আইয়ূবসহ সকল শহীদের সাহসী চেতনায় একটি সুন্দর সাম্য ও মানবিক মর্যাদার দেশ গড়ার প্রত্যয় হোক আমাদের সবার।
লেখক: হাসিব আহমেদ (শিক্ষার্থী, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল)।
বিডিনিউজ ইউরোপ /১৪ ফেব্রুয়ারী / জই