জেনথিপি
– নাবিলা আলম খান
–
সক্রেটিসের বিধবা মা সক্রেটিসকে শুধু দুটি কাজ করতে বলেন – সক্রেটিসের বাবার শুরু করা মূর্তিগুলো শেষ করতে হবে আর তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে। এই দুটি কাজের মধ্যে দ্বিতীয় কাজটিকেই সহজ ভেবে সক্রেটিস বিয়ে করতে রাজি হল।
সক্রেটিসের জন্য পাত্রী পাওয়া সহজ ছিল না। সে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হলেও বিয়ের বাজারে জ্ঞানের কোন দাম নেই। সক্রেটিসের মা সক্রেটিসের জন্য মেয়ে ঠিক করলেন। এমন মেয়ে যে সবাইকে হুকুম দেয়, বকাবকি করে আবার আনন্দে চুপিচুপি কান্না করে! একেবারে নারিকেল স্বভাব। ভেতরে টলটলে পানি, আর বাইরে ভীষণ শক্ত। মেয়েটির নাম জেনথিপি। মানে হলুদ রঙের ঘোড়া। সক্রেটিসের মা ভাবলেন- সক্রেটিসের জন্য এরকম একটি ঘোড়াই দরকার। শক্ত মেয়ে না হলে সক্রেটিসকে নিয়ে সংসার করতে পারবে না।
গ্রিকরা বিয়ের প্রস্তাব দেয় আপেল দিয়ে। কোন মেয়েকে পছন্দ হলে, তার দিকে আপেল ছুঁড়ে দেয়। যদি মেয়েটি আপেলটি ধরে মিষ্টি হাসি দেয়, মেয়েটি রাজি। আর আপেল না ধরলে মেয়েটি রাজি না। এক সুন্দর বিকেলে জলপাই বাগানে, সক্রেটিস আপেল হাতে তাকিয়ে আছে জেনথিপির দিকে। জেনথিপি তাকালো সক্রেটিসের দিকে। তার বুক কাঁপছে। এই লোক তো জ্ঞানী, প্রেমিক না। তো এর হাতে আপেল কেন? সে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে!
সেদিন জলপাই বাগানে আপেল ছুড়তে পারেনি সক্রেটিস। তবুও ৩৭ বছরের সক্রেটিসের সঙ্গে ১৩ বছরের জেনথিপির বিয়ে হয়ে গেল। সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতার ক্লান্তিতে জেনথিপি রাতে ঘুমিয়ে গেল। সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে সক্রেটিস প্রতিজ্ঞা করল, এই মেয়েটির সাথে সে কোনদিন খারাপ ব্যবহার করবে না। মেয়েটি কিছু বললে, সে রাগ করবে না। ওর সব রাগ-অভিমান মুখ বুজে সহ্য করবে।
বিবাহিত জীবন মানুষের এক নতুন অভিজ্ঞতা। সক্রেটিসের বউ চায়, সে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরুক, বাজার করুক, খুনসুটি করুক। এর কোনোটাই সক্রেটিসের পছন্দের কাজ না। এর ফলে বিয়ে করে বিপদে পড়েছে সক্রেটিস। এখন তার জন্য একটি মেয়ে অপেক্ষা করে। সারাদিন তার কথা মনে করে সন্ধ্যা হলে একটু পরপর দরজার দিকে তাকায়। মেয়েটিকে সুখে রাখতে হবে। তার মন রেখে চলতে হবে। সেই মেয়েটির কিছু জিনিস পছন্দ হয়, আবার কিছু জিনিস পছন্দ হয় না। কিন্তু পছন্দ না হলেও মানিয়ে নিতে হবে। পালানোর উপায় নেই।
সক্রেটিস বুঝে গিয়েছিল – আদর্শ স্বামী সে হতে পারবে না। তবে বিয়ের রাতে যে শপথ সে নিয়েছে, সেটা সে মানে। সে জেনথিপির কথা মুখ বুজে শোনে। কথা ভাল লাগলে জবাব দেয়। না লাগলে চুপ থাকে। কোনদিন জেনথিপির সাথে রাগ করে না।
জেনথিপি স্বামীর যে ছবি ছোটবেলা থেকে কল্পনা করেছে, সক্রেটিস কোনোভাবেই সেরকম না। বিয়ের আগে আপেল হাতে সক্রেটিসকে দেখে যে মধুর সুর তার মনে এসেছিল, সেই সুর সবসময় শুনতে চায় জেনথিপি। যে করেই হোক দুই জীবনকে এক করে সুখী দাম্পত্য চাই। সেই উদ্দেশ্যে জেনথিপি স্বামীর জন্য যে অস্ত্র ঠিক করেছে, সেই অস্ত্রের নাম – ঝাড়ি অস্ত্র। সে সারাদিন ঝাড়ি দেয়, উঠতে-বসতে বকাঝকা করে। ফলাফল হয়েছে সক্রেটিসও আদর্শ স্বামী হয়নি, জেনথিপিও হতে পারেনি আদর্শ স্ত্রী। সক্রেটিস হয়ে গেছে সংসার বিমুখ, আর জেনথিপির পরিচয় সে এক মুখরা নারী।
তারা দুজনেই দুজনকে ভালবাসে। কিন্তু কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টাই করেনা। তাই তাদের সংসারে সকাল-বিকাল চিৎকার। চিৎকার জেনথিপি একাই করে। সক্রেটিস শুধু শোনে। এ চেঁচামেচিতে সক্রেটিসের মায়ের সমর্থন আছে। মা জানেন সক্রেটিসকে পথে রাখতে বউকে শক্ত হতে হবে। তাই মা তার ছেলের বউকে সংসার চালানোর কৌশল থেকে জমি জমার হিসাব, টাকা-পয়সার হিসাব সবকিছু শিখাচ্ছেন।
জেনথিপি সক্রেটিসের জন্য নিজের হাতে কাপড় বোনে। সারাদিন ধরে সক্রেটিসের জন্য রান্নাবান্না করে খাবার নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু সক্রেটিসের দেখা নেই। খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে যখন তার মাথা ভীষণ রকম গরম হয়ে যায়, তখন সক্রেটিস বাড়ি ফেরে। তখন আর সক্রেটিসের কপালে খাবার জোটে না, জোটে রাশি রাশি গালি!
এই জীবনে সক্রেটিস সুখী। সংসার নিয়ে সক্রেটিসের কোন অভিযোগ নেই, কোন কষ্ট নেই। কিন্তু জেনথিপি মানতে পারেনি। তাই সে কষ্ট পায় আর গালাগালি করে।
কিন্তু সক্রেটিস জানে জেনথিপির ভালোবাসা তীব্র, তাই রাগও বেশি, সেজন্যই বকা ঝকা মাত্রাহীন। সে বন্ধুদের হাসিঠাট্টায় বুঝিয়ে দেয় যে জেনথিপিকে সে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।
জেনথিপিও স্বামীর গর্বে, গর্ব অনুভব করেন। তাইতো এথেন্সের দেবী এথিনার মন্দির পার্থেনন দেখতে গিয়ে যখন সক্রেটিস সবাইকে মূর্তি এবং ভবনগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিল আর তাতে সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, তখন জেনথিপির অনেক ভালো লাগে। স্বামীর গরবে গরবিনী হলে যে এতো ভাল লাগে তা জেনথিপি এতদিন জানতো না। সেখানে সক্রেটিস বলেন, এই মন্দিরের ভার যেমন কয়েকটী নারী মূর্তির মাথায়, তেমনি আমার সংসারের পুরো বোঝাও ঠিক জেনথিপির মাথায়।
এথেন্সে যখন প্লেগের আক্রমণ বেড়ে গেল তখন সক্রেটিসের বন্ধুরা সক্রেটিসকে নিয়ে থেসালী নগরে যাবে ঠিক করল। কিন্তু সক্রেটিস রাজি না হওয়ায় তারা জেনথিপির কাছে গেল সক্রেটিসকে রাজি করাতে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেনথিপি বলল, সক্রেটিস যা ভালো বোঝে তাই হবে, আমরা এখানেই থাকবো।
জেনথিপির ভালোবাসার অনেক শক্তি। সে নিজের হাতে সক্রেটিসকে নতুন কাপড় পড়িয়ে, চুল আঁচড়ে দিয়ে, পায়ে চটি পড়িয়ে সিম্পোজিয়ামে পাঠায়। যদিও সক্রেটিস বলে, তোমার মান রাখতে আমি সেজেগুজে সিম্পোজিয়ামে যাচ্ছি। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। শুধু একটা অনুরোধ সক্রেটিসকে বদলে ফেলো না।
সক্রেটিস জেনথিপির সাথে মজাও করত। একবার থেসালীর রাজা সক্রেটিসকে সস্ত্রীক দাওয়াত দিলেন। জেনথিপিও খুবই আগ্রহী হলো সেখানে গেলে সচ্ছলতা আসবে এই ভেবে। কিন্তু যখন সক্রেটিস বলল যে সেখানকার মেয়েরা খুব সুন্দর, তখন জেনথিপি চিৎকার করে উঠল, চুলোয় যাক তোমার টাকা-পয়সা। সেখানে তোমার যাওয়া হবেনা। সক্রেটিস মনে মনে হাসল।
সক্রেটিস-জেনথিপি দম্পতির তিন সন্তান। গ্রীসের নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম সন্তান ছেলে হলে নাম রাখা হয় বাবার বাবার নামে। কিন্তু সক্রেটিস স্ত্রীর প্রতি সম্মান জানিয়ে বড় ছেলের নাম রাখলেন জেনথিপির বাবার নামে, লেমপ্রোক্লিস। স্বামীর এ উদারতায় জেনথিপি মহাখুশি, সে জানে তার স্বামী অত্যন্ত বড় মনের মানুষ। তারা তাদের দ্বিতীয় ছেলের নাম রাখলেন সক্রেটিসের বাবার নামে, সফ্রোনিকাস।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যখন মামলা হল খবর শুনে জেনথিপি পাগলের মতো করেন। সক্রেটিসের বিপদে সেই মুখরা মেয়েটিই বুক আগলে সক্রেটিসের পাশে দাঁড়ান। সক্রেটিসের সংসার দেখে প্লেটো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে জীবনে বিয়ে করবে না। কিন্তু সক্রেটিসের বিপদে সক্রেটিসের প্রতি জেনথিপির ভালোবাসা দেখে ভাবল বউ জিনিসটা মনে হয় এত খারাপ কিছু না!
কারাগারে জেনথিপি সক্রেটিসকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। সক্রেটিস জেলখানায় বসে জেনথিপির জন্য কবিতা লেখেন। জেনথিপি মহা খুশি। খুশিতে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। সব কান্নার কারণ হয়না।
সক্রেটিসের হেমলক পানের আগের রাতে সক্রেটিস ও জেনথিপি জেলখানায় সারারাত গল্প করে; সমস্ত না বলা কথা, প্রশ্ন সমাধান করে নেয়। একবার লোকে ছড়িয়ে দিল যে সক্রেটিস নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আসলে তেমন কিছু ঘটেনি। সক্রেটিস একথা জেনথিপিকে জানাতেই জেনথিপি বলে যে, সে জানে সক্রেটিস দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। নিজেই সরে এসেছেন, তবুও সক্রেটিসের মুখ থেকে শুনে ভীষণ ভালো লাগলো। তার মনে এটা নিয়ে অনেক দিনের একটা চিনচিনে ব্যথা ছিল। সেটা চলে গেল।
সক্রেটিসের জীবনের শেষ রাতে কারাগারে জেনথিপি স্বামীর সাথে ছিল। সেই রাতে জেনথিপি বুঝতে পারে যে, সে আসলে সারা জীবন সব কিছুতেই সক্রেটিসের সাথে অভিমান করে গেছে। তাই দাম্পত্যের অনেক কিছুই উপভোগ করতে পারেনি। বুহতে পেরে জেনথিপি কাঁদে। আর সক্রেটিস ভাবে, সারা জীবন এই মেয়েটিকেই শুধু কষ্ট দিয়েছি। দুনিয়ার সব মানুষের জন্য সুন্দর জীবন খুঁজেছি। শুধু জেনথিপিকেই দিয়েছি একটি অসুন্দর জীবন। সক্রেটিসেরও কান্না পায়। দুজন দুজনের জন্য কাঁদে। রাত বয়ে চলে…!
জেনথিপি বারবার বাইরে তাকাচ্ছে। তার ভয়- কখন যেন আকাশ ফর্সা হয়ে যায়! রাত্রি শেষ হয়ে যায়। সে জোড় করে সক্রেটিসকে ঘুম পাড়াতে চাইছে। তাদের বিয়ের প্রথম রাত জেগেছিল সক্রেটিস। আজ শেষ রাত। সক্রেটিস ঘুমাক। জেগে থাকবে জেনথিপি।
সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা হলে সে লেখায় জেনথিপি থাকবেই। জেনথিপিকে বাদ দিয়ে সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা যাবে না। কিন্তু সক্রেটিসের বউ কে এমন ভাবে তুলে ধরা হয় যেন তার চরিত্র ভয়ংকর। সে সারা জীবন শুধু সক্রেটিসকে জ্বালিয়েছে।
যেমন, একবার তিনি সক্রেটিসের মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছিলেন উত্তেজিত হয়ে। সক্রেটিস তখন বলেন “গর্জনের পরেই নামে বারিধারা (After thunder comes the rain)।” আবার সক্রেটিসের প্রচলিত বাণীগুলোর মধ্যে একটা বাণী এরকম- “যদি বউ ভাল হয় তাহলে তুমি পাবে একটি সুন্দর জীবন, আর যদি বউ খারাপ হয়, তুমি হবে একজন দার্শনিক।” এজন্যও মনে হতে পারে, সক্রেটিসের বউ দজ্জাল! ইংরেজি অভিধানে Xanthippe শব্দের অর্থই “a scolding or ill – tempered wife; a shrewish woman”!
কিন্তু বন্ধুরা যখন সক্রেটিসকে তার বউ নিয়ে কথা তুলতো তখন সক্রেটিস জবাব দিয়েছে যে, জেনথিপির তর্ক করার স্পিরিট এর জন্যই সে তাকে পছন্দ করেছে। সক্রেটিস বলেন- জেনথিপি মানে হলুদ ঘোড়া। ঘোড়া যদি আনতেই হয় এমন ঘোড়া আনলাম, যে ঘোড়া সামলানো সবচেয়ে কঠিন। এখন আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, যখন জেনথিপি নামের ঘোড়াটিকে সামলাতে পারছি, আমি দুনিয়ার যেকোন ঘোড়াকেই সামলাতে পারবো।
জেনথিপির স্বামীর প্রতি রাগ দেখানোর যথেষ্ট কারণ ছিল বলা যায়। তার ঝাঁঝ হয়ত বেশি ছিল। কিন্তু যেভাবে তাকে কলহপ্রিয়, বদমেজাজি, স্বামী নির্যাতনকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়, হয়তো তিনি তেমন ছিলেন না। জেনথিপি ছিল একটি বাস্তব চরিত্র। আমাদের সমাজেও এটি খুব সাধারণ একটি চিত্র। আসলে নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ নেই। দুজনই সমান গুরুত্ত্বপূর্ণ। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিজেদের উপরই নির্ভর করে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও আস্থা একটি সম্পর্ককে সুন্দর করে তোলে। একজনকে পিছিয়ে রেখে অন্যজনের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন। তাইতো আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামে মতো বলতে পারি-
‘সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’
তথ্যপঞ্জী:
১। ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’, সুজন দেবনাথ।
নাবিলা আলম খান
প্রভাষক, প্রাণিবিদ্যা
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া।
বিডিনিউজ ইউরোপ২৪ডটকম/২৩ফেব্রুয়ারি/জই